ফেনীর সাবেক এসপি জাহাঙ্গীরের রোষানলের শিকার ৪ সাংবাদিক এখনো ১২ মামলার ঘানি টানছে
বহুল আলোচিত ফেনীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার রহস্য উদঘাটনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় তৎকালীন পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারের রোষানলের শিকার ফেনীর ৪ সাংবাদিক এখনো ১২ মামলার ঘানি টানছেন। করোনাকালে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় হাজিরা দিতে না হলেও বর্তমানে ফের তাদেরকে সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন এসব মামলায় আদালতে হাজির হতে হচ্ছে।
এতে করে সাংবাদিকদের আর্থিক, মানসিক তথা স্বাভাবিক জীবন বিপন্নের পথে। তারা উচ্চ আদালত থেকে সবকটি মামলায় জামিন লাভের পর নিম্ন আদালত থেকে ফের জামিন পান। এদিকে গত বছরের ২৪ অক্টোবর নুসরাত হত্যার রায়ে চার্জশিটভুক্ত ১৬ আসামীরই ফাঁসির রায় হয়েছে। মামলাটি উচ্চ আদালতে আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
গত বছরের (২০১৯) ১২ মে সন্ধ্যায় সমালোচিত এসপির বদলী আদেশ আসার পর তড়িঘড়ি করে তিনি রাতে জরুরি ভিত্তিতে ওসিদের ডেকে চাপ প্রয়োগ করে কয়েকটি চার্জশীট তৈরি করান। এ বিষয়ে দৈনিক সংবাদ প্রথম খবরটি পরিবেশন করলে সাংবাদিক নিপীরণের অভিনব কাহিনির বিষয়টি সামনে আসে।
এর আগে ২৭ মার্চ ঘটনার শুরু থেকেই সোনাগাজীর তৎকালীন ওসি (বর্তমানে কারাবন্দী) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন নুসরাত হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেন। আর তাতে সমর্থন যোগান এসপি জাহাঙ্গীর সরকার। সাংবাদিকরা প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরায় ও পুলিশি তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হয়ে প্রত্যাহার হন এসপি-ওসি। তখন ক্ষিপ্ত হয়ে ফেনী ছাড়ার আগে পূর্বের বিভিন্ন তদন্তাধীন মামলার চার্জশীটে ৪ সাংবাদিকের নাম জড়িয়ে দেন। উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেও নিম্ন আদালতে রীতিমতো হাজিরা দিতে হচ্ছে এসব ভুতুড়ে মামলায়।
ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা জানান, এসব মামলার এজাহারে তাদের কারোই নাম ছিল না। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে কখনো সাধারণ ডায়েরিও হয়নি। কেবলমাত্র নুসরাত হত্যাকান্ডে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরায় ক্ষিপ্ত এসপি পরিকল্পিতভাবে তাদের এসব মামলার চার্জশীটে নাম দিতে ওসিদের বাধ্য করেন। ফেনী ছাড়ার আগে ওইসব চার্জশীট নিশ্চিত করতে ওসিদের এসিআর আটকে রাখেন বলেও সংশ্লিষ্টরা জানান। কোন কোন মামলার এজাহারে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের নাম থাকলেও চার্জশীটে তাদের বাদ দিয়ে তদস্থলে সাংবাদিকদের নাম জড়িয়ে দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি। ওইদিনই স্থানীয় জনতা অধ্যক্ষকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেন। এ ঘটনায় রাফির মা শিরীন আক্তার বাদী হয়ে থানায় অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলা প্রত্যাহার করতে হুমকি-ধমকি দেন অধ্যক্ষের সাঙ্গপাঙ্গরা। একপর্যায়ে ৬ এপ্রিল পরীক্ষার পূর্ব মুহূর্তে মাদরাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাত রাফির শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রেরণ করে। ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে তার মৃত্যু হয়। সেদিন মামলাটি পিবিআই গ্রহণ করে।
শুরু থেকেই ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করেন সোনাগাজী মডেল থানার প্রত্যাহার হওয়া ওসি মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। তার পক্ষে অবস্থান নেন পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার। তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে ওসির পক্ষে সাফাই গেয়ে চিঠি লিখেন। ঘটনাটি নিয়ে যখন দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম সরব, এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই নুসরাত এর উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারে নির্দেশ দেন তখনও ঘটনাস্থলে যাননি এসপি জাহাঙ্গীর সরকার।
মামলায় সিরাজ উদ দৌলাসহ কয়েকজনকে আসামী করতে এসপি-ওসি তালবাহানা করেন বলে নুসরাতের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠে। তাদের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠে। মামলাটি পিবিআইতে স্থানান্তরের পর ঘটনায় জড়িতরা একে একে গ্রেফতার হতে থাকে। বেরিয়ে আসে ঘটনার মূল রহস্য। একপর্যায়ে পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্তে এসপি-ওসি সহ ৪ পুলিশ দোষী সাব্যস্ত হন। ওসি মোয়াজ্জেমকে বরখাস্ত করে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। আর এসপি জাহাঙ্গীর সরকারকে প্রত্যাহার করে সংযুক্ত করা হয় পুলিশ সদর দপ্তরে। অপর দুইজনকেও প্রত্যাহার করে পার্বত্য এলাকায় সংযুক্ত করা হয়।
এদিকে নুসরাত রাফির জবানবন্দী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া ওসি মো. মোয়াজ্জেমের হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন ব্যারিস্টার সুমন। ওই মামলায় কারাগারে রয়েছেন ওসি মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম অবস্থায় এ ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে তার মোবাইল থেকে ফুটেজটি চুরির অভিযোগ এনে সময় টিভির ফেনী ব্যুরোর রিপোর্টার আতিয়ার হাওলাদার সজলের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে সজলও পাল্টা ডায়েরি করেন।
জেলা পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এসপি জাহাঙ্গীর ফেনী ছাড়ার আগেই কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এ সময় তিনি এ ঘটনায় তাকে নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কয়েকজন সাংবাদিককে হেনস্থা করার পরিকল্পনা নেন। তাদের নাম সংবলিত একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের ধরিয়ে দেন। বিভিন্ন তদন্তাধীন মামলায় উল্লিখিত সাংবাদিকদের নাম চার্জশীটে অন্তর্ভূক্ত করার নির্দেশ দেন। কয়েকজন ওসি কৌশলে এড়িয়ে গেলেও অন্যদের এসিআরের ভয় দেখিয়ে আদালতে চার্জশীট দাখিলের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন জাহাঙ্গীর সরকার।
১২ মে সন্ধ্যায় এসপির বদলী আদেশ আসার পর তিনি রাতে জরুরি ভিত্তিতে ওসিদের ডেকে চাপ প্রয়োগ করে কয়েকটি চার্জশীট তৈরি করান এবং পরদিন তা দাখিলে বাধ্য করেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ওসি জানান। এমনকি বিষয়টি গোপন রাখতেও কোর্ট পরিদর্শকসহ অন্যদের নির্দেশ দেন তিনি। পরে বিষয়টি ফাঁস হলে ফেনীতে কর্মরত সাংবাদিক ও সচেতন মহলে ক্ষোভ-অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। তৎকালীন জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি আবদুর রহমান বি.কম ও সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী এমপিও এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ইতিমধ্যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফেনী মডেল থানায় ৩, সোনাগাজী মডেল থানায় ২, দাগনভূঞা থানায় ২ ও ছাগলনাইয়া থানায় ২টিসহ মোট ১২টি মামলার চার্জশীট আদালতে জমা হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব মামলার অধিকাংশই বাদী পুলিশ। জমা দেয়া চার্জশীটে সাংবাদিকদের মধ্যে দৈনিক ফেনীর সময় ও সাপ্তাহিক আলোকিত ফেনী সম্পাদক মো. শাহাদাত হোসেন, দৈনিক অধিকার প্রতিনিধি ও অনলাইন পোর্টাল ফেনী রিপোর্ট সম্পাদক এস এম ইউসুফ আলী, বাংলানিউজ স্টাফ রিপোর্টার ও সাপ্তাহিক হকার্স এর বার্তা সম্পাদক সোলায়মান হাজারী ডালিম এবং দৈনিক সময়ের আলো প্রতিনিধি ও দৈনিক স্টারলাইনের বার্তা সম্পাদক মাঈন উদ্দিন পাটোয়ারির নাম রয়েছে।
ভুক্তভোগী সাংবাদিক দৈনিক ফেনীর সময় এর সম্পাদক মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, এসব ভুতুড়ে মামলার ঘটনা ফাঁস হলে সারাদেশে কর্মরত সাংবাদিক ও সচেতন মহলে ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় উঠে। তারা উচ্চ আদালত থেকে সবকটি মামলায় জামিন লাভের পর নিম্ন আদালত থেকে ফের জামিন পান। এক্ষেত্রে সদ্যপ্রয়াত জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আকরামুজজমান প্রধান কৌশলী হিসেবে আদালতে সাংবাদিকদের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখেন।
সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক ফেনী জেলা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট লক্ষণ বণিক বলেন, শুধুমাত্র সংবাদ প্রকাশের জের ধরে এতগুলো মামলার চার্জশীটে সাংবাদিকদের জড়ানো নজিরবিহীন। ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করতে এসপির নির্দেশে তদন্ত কর্মকর্তারা এমন বেআইনী কাজ করেছেন। বিষয়টি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবি জানান তিনি।
ফেনী প্রেস ক্লাব সভাপতি মু. আবু তাহের ভূঁইয়া বলেন, তৎকালীন পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর সরকার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে সাংবাদিকদের মামলায় জড়িয়েছেন। এক বছর ধরে তারা এসব ভুতুড়ে মামলায় আদালতে রীতিমত হাজিরা দিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। সাংবাদিক নিপীড়নের এ জঘন্য ঘটনার জন্য তিনি বিতর্কিত এসপি জাহাঙ্গীর সরকারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।