স্টাফ রিপোর্টার:
ফেনী জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ও ২০২৪ সালে দাগনভূঞা উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় দীর্ঘ ১৫ বছর স্কুলে কোনো ক্লাস না করিয়ে স্কুল থেকে নিয়মিত মাসিক বেতন ভাতা এবং একইসঙ্গে জেলা পরিষদ থেকে সদস্য পদের মাসিক সম্মানি ভাতা নিয়মিত তুলে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে দাগনভূঞা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান, দাগনভূঞা উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, জয়লষ্কর উচ্চ বিদ্যালয়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষিকা রাবেয়া আক্তার রাবুর বিরুদ্ধে।
দলীয় দাপটে বিগত পনের বছর কেউ মুখ না খুললেও ৫ ই আগষ্ট সরকার পতনের পর তার থলের বিড়াল বের হয়ে আসে। এই সব অনিয়মের বিরুদ্ধে তার ও তখনকার প্রধান শিক্ষক বেলাল মিয়াজি বিরুদ্ধে গত ২০ শে আগষ্ট স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা তাদের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করে । কিন্তু এরই মধ্যে বেলাল মিয়াজি অপসারণ হলেও রাবেয়া আক্তার রাবু ম্যানেজ করে রয়ে গেছেন সহপদে বহাল তবিয়তে।
দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করে চলতেন। ফেনী নিজাম হাজারির সাথে ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ফেনী যুব মহিলালীগের বড়মনির ছিলেন সেকেন্ড ইন কমান্ড।সে সুবাধে হয়েছেন সম্পদের মালিক। অনুসন্ধান করে জানা যায় জয়লষ্কর স্কুলের পাশে কিনেছে ফ্ল্যাট, জমি, মেয়েকে পড়াচ্ছেন ডাক্তারি। বেকার স্বামিকে ধরিয়ে দিয়েছেন নানা সময় নানা ব্যবস্যা। তার স্বামী নুর নবী তার দাপট দেখিয়ে চলতেন, এলাকায় রাবুর দাপটে সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জন থেকে ব্যাবসার কথা বলে টাকা ধার নিয়ে ফেরত দিতেন না। এমনকি ঘরের ফার্নিচার নিয়ে দোকানে টাকা পরিশোধ করেননি। এমন অনেক তথ্য প্রমাণ আমাদের কাছে এসেছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দাগনভূঞা উপজেলার জয়লষ্কর এলাকায় জয়লষ্কর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রায় বিশ বছর আগে মানবিক বিভাগের এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান রাবেয়া আক্তার রাবু। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। এক সময় তিনি ফেনীর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের নজরে আসেন এবং ধীরে ধীরে নেতাদের সাথে সক্ষতা গড়ে ওঠে। তিনি এমপিওভুক্ত শিক্ষক পদে থেকে ২০১৮ সালে ফেনী জেলা পরিষদ নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হন।
জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ২০১৮ সাল থেকে থেকে ২০২৩ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দ্বিতীয়বার দাগনভূঞা উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে ২০২৪ সালের মার্চ থেকে ৪ ই আগষ্ট পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্কুলের বিভিন্ন ক্লাসের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী বলেন, রাবেয়া আক্তার রাবু জেলা পরিষদের সদস্য ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকাবস্থায় কোনোদিন স্কুলের ক্লাস করাননি। তবে মাঝেমধ্যে স্কুলে আসা-যাওয়া করতেন। অনেক ছাত্র ছাত্রী তাকে শিক্ষক হিসেবে চিনেওনা।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো নীতিমালা অনুযায়ী একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক একসাথে দুইটি চাকরি বা আর্থিক লাভজনক অন্য কোনো পদে থাকতে পারেন না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমপিও নীতিমালা ২০১৮ ও ২০২১ এর ১১.১৭ ধারায় বলা হয়েছে, এমপিওভুক্ত কোনও শিক্ষক-কর্মচারী একইসঙ্গে একাধিক কোনও পদে/চাকরিতে বা আর্থিক লাভজনক কোনও পদে নিয়োজিত থাকতে পারবেন না। এটি তদন্তে প্রমাণিত হলে সরকার তার এমপিও বাতিলসহ দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। অথচ সরকারি বিধিবিধান উপেক্ষা করে দুই প্রতিষ্ঠানেই দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
শিক্ষক রাবেয়া আক্তার রাবু ক্ষমতার অপব্যবহার করে একসঙ্গে দুটি পদে থেকে উভয় প্রতিষ্ঠান থেকেই আর্থিক সুবিধা নেয়ার বিষয়টি ‘অপেন সিক্রেট’ হলেও তৎকালীন সময় এই অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস করেননি কারণ ফেনী জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জয়লষ্কর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন মামুনুর রশীদ মিলন। তিনি আবার জয়লষ্কর উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি রাবুকে সব কিছু সহযোগিতা করতেন। তার দাপটে রাবু ধরাকে সরাজ্ঞান করে চলতেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন ও অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই নতুন করে এমপিওভুক্ত ওই শিক্ষকের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আনেন।
স্থানীয়রা বলেন, জেলা পরিষদের সদস্য ও দাগনভূঞা উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং দাগনভূঞা উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতিথাকা অবস্থায় স্কুলে কোনো ক্লাস না করিয়ে তিনি কিভাবে স্কুল থেকে মাসিক বেতন (এমপিও) এবং জেলা পরিষদ থেকে সম্মানি ভাতা নেন এবিষয়টি সুষ্ঠু তদন্ত করা দরকার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফেনী জেলা পরিষদের হিসাব রক্ষক বলেন, সাবেক জেলা পরিষদের সদস্য রাবেয়া আক্তার রাবু ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জেলা পরিষদ থেকে নিয়মিত সদস্যর সম্মানি ভাতার সরকারি অংশ এবং পরিষদ থেকে প্রদত্ত ভাতা তুলেছেন।
এই ব্যাপারে সদ্য প্রত্যাহারকৃত প্রধান শিক্ষক বেলাল মিয়াজির সাথে ফোনে কথা বললে তিনি বলেন রাবেয়া আক্তার রাবু সহকারী শিক্ষক থাকা অবস্থায় তিনি জেলা পরিষদের সদস্য ও পরে চলতি বছর দাগনভূঞা উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং একাধারে তিনি দাগনভূঞা উপজেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ছিলেন। তখন তিনি এই সব দায়িত্ব পালন করার কারনে স্কুলে পাঠদান করাতেন না। তার বদলে তার স্বামী ক্লাস করতেন কোন রেজুলেশন ছাড়া। শুধুমাত্র সভাপতি আদেশে।
জয়লষ্কর উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সেলিনা আক্তার জানান, আমাদের স্কুলের এমপিওভুক্ত শিক্ষক রাবেয়া আক্তার রাবু ফেনী জেলা পরিষদের সদস্য ও দাগনভূঞা উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় স্কুল থেকে নিয়মিত বেতনের সরকারি অংশ তুলেছেন। ক্লাস না করিয়ে এতো বছর বেতন নেয়ার বিধি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে তিনি ক্লাস না করলেও ওইসময় প্রায়ই স্কুলে আসা-যাওয়া করতেন। তার ক্লাসগুলো করানোর জন্য তার বদলে তার স্বামী স্কুলে পড়াতেন নামে মাত্র। বেতন কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি প্রধান শিক্ষক হওয়ার আগ থেকেই তিনি ওই স্কুলে যোগদান করেন। তখন বেতনের স্কেল কম ছিল। বর্তমানে প্রতি মাসে বেতনের সরকারি অংশ (এমপিও) ২৪ হাজার ৭০০ টাকা নিচ্ছেন। আর স্কুলের কমিটি থেকে তার বেতন বাবত আরও কিছু অংশ দেওয়া হয়। ক্লাস না করিয়ে বেতন এবং একসঙ্গে দুই জায়গা থেকে বেতন ও সম্মানির বিষয়ে বিধিমালা কি বলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি অবশ্যই নিয়মবহির্ভুত।
এই ব্যাপারে রাবেয়া আক্তার রাবুর সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন একসঙ্গে দুই জায়গা থেকে বেতন ও সম্মানি নিতে পারবেন মর্মে তখন আদালতে রিট করা আছে।
এই ব্যাপারে দাগনভূঞা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিবেদিতা চাকমার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন আমার কাছে অভিযোগ এলে আমি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।